নদী (ছদ্দ নাম) খুব সাধারণ পরিবারের একজন সদস্য। ছোট বেলা থেকেই দেখে আসছে তার পরিবারে অর্থের টানাটানি, ক্ষুধা, চিকিৎসা ও সন্তানদের লেখা পড়ার অভাব। নদীর পরিবারে লোক সংখ্যা ১০ জন। উপার্জনশীল সদস্য ৩জন। তার পরেও এতো সমস্যা। কারণ তখন তারা তিন জন মিলে যে অর্থ আয় করতেন, পুরো টাকাটাই সংসারে ব্যহিসেবীর মতো খরচ করতেন। হঠাৎ করে কোন সমস্যায় পড়লেই হাত বাড়াতে হতো অন্যের কাছে। নদী অনুভব করতো, কিন্তু কাউকে কিছু বলতে পারতো না কারণ সে ছিল বয়সে ছোট। এভাবেই টানাপোড়ার মধ্য দিয়ে চলছিল তাদের পরিবার। দশ বছর পর নদীর বিয়ে হয়ে গেল এমন একটি পরিবারে সেখানে গিয়েও দেখল একান্নবতীর্ পরিবার। অভাব, কুসংস্কার ও আর্থিক অনাটন। নদী একটি এনজিওতে চাকরী করতো। সেই সুবাদে স্বামীর সাথে ঢাকায় থাকার সৌভাগ্য হয়। বেশ কয়েকদিন পর নদীর এক আত্মীয়া তাকে নিয়ে যায় ঢাকার ক্রেডিটের সেই ছোট্ট টিনসেট ঘরটিতে (আশির দশকে)। যা এখন মাথা উচু করে দািঁড়য়ে আছে। ক্রেডিটের অফিস কক্ষে প্রবেশ করতেই তার আত্মীয়া পরিচয় করিয়ে দেয়, নদী— এই আমাদের জন’দা। যিনি ছিলেন সবার জন’দা। মোটামুটি বৃদ্ধা একজন দাদা। তিনি আজ নেই কিন্তু তার কথাগুলি আজও নদীর মনে বাঁজে। নদীকে সেদিন জন’দা বলেছিল মা তুমি বই করতে এসেছ? কি করবে বই করে? তুমি কি কিছু কর? নদী উত্তরে বলেছিল, হ্যাঁ দাদা আমি একটি এনজিওতে চাকুরী করি। দাদা তাকে হাঁসি মাখা মুখে বলেছিলেন, তাহলে তো ভাল। প্রতি মাসে বেতনের একটা অংশ এখানে জমা করবে, ভবিষ্যতে কাজে লাগবে।
দুই বছর পর নদী একটি বিয়ের উদ্দেশ্য জানিয়ে ঋণের আবেদন করে। সেদিন জন’দা বলেছিলেন বিয়ের জন্য ঋণ করবে? এটাতো উৎপাদনশীল খাত নয়। ঋণ করতে হয় এমন কাজের জন্য যেখান থেকে তোমার লাভ হবে। ঋণ করে ফেলে রাখবে না তো? তাহলে তোমার জামিনদাররা পরবতীর্তে ঋণ তুলতে পারবেনা। নদী একটু অবাক হয়েছিল। তার টাকা সে তুলবে আর ফেলে রাখবে এটা কেমন কথা? যাই হোক নদী খুব তারাতারি ঋণটা পরিশোধ করেছিল। নদীর স্বামী প্রতি মাসেই গ্রামের বাড়ীতে টাকা পাঠাতো এবং নিজেরাও নানা সমস্যার মধ্যে দিয়ে সংসার চালাতো। তারা দুইজন পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত নিল আবার ঋণ করে গ্রামের বাড়ীতে জমি বন্ধক রাখবে। তাহলে প্রতি মাসেই গ্রামে টাকা পাঠাতে হবেনা। এভাবেই চলছিল প্রায় আট দশ বছর। তারপর হঠাৎ একদিন নদী জানতে পারে তার এনজিওটা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। স্বামীর একার উপার্জনে ঢাকা থাকা তাদের জন্য কষ্টকর। তাই তারা সিদ্ধান্ত নিল ঋণ করে একটি বাড়ী করবে এবং নদী ফিরে যাবে গ্রামে। গ্রামে ফিরে গিয়ে নদী বসে থাকেনি। সেখানে ঋণদান সমিতিতে বই করে একটার পর একটা ঋণ পরিকল্পিতভাবে গ্রহণ করে তা বাস্তবায়ন করেছে। যতটুকু ঋণের কিস্তি দিতে পারবে ঠিক ততটুকু ঋণই সে গ্রহণ করেছে এবং তা উন্নয়ন খাতে ব্যয় করেছে। নদী শুধু তার নিজের পরিবারে উন্নয়ন করেনি, নিকটতম আত্মীয় স্বজনদের ক্রেডিটে বই করার জন্য সহায়তা করেছেন। তার পরিবারের প্রধানদের চিন্তাধারা ছিল পরিবারে মাত্র একটি সদস্যপদ থাকাই যথেষ্ট। আলাদা আলাদা সঞ্চয় করলে পরিবারে ভাঙ্গন ধরবে। এমন চিন্তাধারাকে সরাতে নদীর অনেক সময় লেগেছে। একান্নবতীর্ পরিবার ভাগ হয়ে এখন আটটি পরিবারে বিভক্ত হয়ে নিজ নিজ বাসস্থান তৈরী করেছে এবং উন্নয়নমূলক খাতে ঋণ গ্রহণ করে পরিশোধ করছেন।
নদীর কাছে যারা পরামর্শ চাইতে আসতো নদী তাদের সবসময় বলেন পরিবারের সবার আয় একত্রিত করে আগে কিছু সঞ্চয় করুন, পরে ব্যয় করবেন। অন্যথায় মাসের শেষে হাত শূন্য। নদী বিভিন্ন প্রশিক্ষনে অংশগ্রহণ করে জেনেছে আয় থেকে ব্যয় বাদ দিয়ে যা থাকে তা দিয়ে সঞ্চয় করা সম্ভব নয়। তাই আগে কিছু টাকা সঞ্চয় করার পর খরচ করুন। নদী ছোট বেলা থেকে অর্থ সংকট খুব কাছ থেকে দেখেছে। তাই তার পরামর্শ সঞ্চয় করুন, সঞ্চয় বিপদের বন্ধু। সঞ্চয়ী মানুষ জীবনে বিপদে কমই পড়ে, যদিওবা পড়ে এ থেকে সহজে বেরিয়ে আসতে পারে। নদী তার ঠাকুমাকে দেখতেন টাকা রুমালে বেধে রাখতে। কিছুদিন পর তা ফাঙ্গাস পড়ে। নদী বলতো ঠাকুমা চঞ্চল টাকা অঞ্চলে বেধ না, তাকে যত ঘুরাবে ততই বাড়বে। তার ঠাকুমা একজন বৃদ্ধ হয়েও সঞ্চয়ীতে টাকা জমা করে প্রয়োজন মত উত্তোলন করেন। নদী সবসময় ভাবে পঞ্চাশ বছর আগের গুনিজনদের কথা। যাদের চোখে দেখেনি শুধু তাদের কথা শুনেছে। তাদের প্রচেষ্টায় বিভিন্ন ধর্মপল্লীতে প্রতিষ্ঠিত হয়ে কাজ করছে খ্রীষ্টান ক্রেডিট ইউনিয়ন গুলি। শ্রদ্ধা জানাই বাংলাদেশে ক্রেডিট ইউনিয়নের জনক ফাদার চার্লস্ জে. ইয়াংকে এবং বনপাড়া ধর্মপল্লীতে আগত ফাদার লুইস পিনোস, দীনোবন্ধু বাড়ৈ ও নাইট ভিনসেন্ট রড্রিক্স সহ আমাদের বনপাড়া ধর্মপল্লীর প্রয়াত গুনীজনদের যাদের প্রচেষ্টায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল আজকের এই ক্রেডিট ইউনিয়ন। যাদের কল্যানে নদী আজ পরিবারে, সমাজে, মন্ডলীতে প্রতিষ্ঠিত।
-মিসেস. পদ্মিনী কস্তা