– স্টেফান উত্তম রোজারিও
স্বপ্ন দেখা আমাদের অভ্যাস আর পূরণ করতে না পারা ভাগ্যের নির্মম পরিহাস। একটি দৈনিকে আমি দেখেছি কোন এক বিখ্যাত ব্যক্তির একটি উক্তি। উক্তিটি এমন, আমি তখন ভাগ্যকে বিশ্বাস করি যখন দেখি অমার মত একজন সাফল্য অর্জন করেছে”। ব্যাখ্যাটি এমন দাঁড়ায়, দুই জনের একটি স্বপ্ন আর দুইজনের সার্বিক অবস্থা একই রকম কিন্তু একজন সাফল্য লাভ করছে অন্যজন ব্যর্থ। তখন ব্যর্থ জন বলে, ওর ভাগ্য ভাল ছিল। অর্থাৎ সফল ব্যক্তির ভাগ্যকে এগিয়ে রেখে নিজের পরাজয়ের সান্ত্বনা খুঁজে বেড়ায়।
স্বপ্নের নাম যখন কর্মসংস্থান আর অর্থনৈতিক উন্নয়নের মাধ্যেমে সমাজকে একটি উন্নত সমাজে রূপান্তর। সমাজ আর পরিবারে সমন্ত অশান্তির মূলে আছে অর্থনৈতিক সমস্য, হোক প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ। আমাদের কর্তমান সমাজ ব্যবস্থায় ক্রেডিট ইউনিয়নের ভূমিকা অপরিসীম। এমন কোন ব্যক্তি বিশেষ করে খ্রীষ্টান ব্যক্তি পাওয়া যাবে না, যে কিনা ক্রেডিট ইউনিয়ন থেকে কোন সময় ঋণ গ্রহণ করেননি। যে কাজেই ব্যবহার করুক, সফল বা ব্যর্থ যাই হোক না কেন ঋণ গ্রহণ করেছে এটাই বড় কথা। কিন্তু ঋণ নিয়ে কাজে লাগাতে না পরলে কি লাভ? না হবে নিজের উন্নয়ন না হবে সমিতির কোন উন্নয়ন। এর জন্য প্রয়োজন ক্রেডিট ইউনিয়নের পক্ষ থেকে নানামূখী ব্যবস্থা গ্রহণ করা। একটা উদাহরণ দিলেই আশা করি পরিস্কার হয়ে যাবে। মানুষ ঋণ নিয়ে আদৌ কি কোন উন্নয়নমূলক কাজে সেই ঋণ ব্যবহার করছে? অনেকেই করছে না। আজকাল দেখা যায় ঋণ নিয়ে ঘরের সোফাসেট, টেলিভিশন, আলমারী, মোবাইল ফোন ইত্যাদি কেনায় ব্যস্ত। আমার কথা হলো কিনুক না তাতে কোন সমস্যা নেই। পরক্ষণেই যদি ঠিকমত কিস্তি না দেয়, নিজেতো পড়ে ফল্টে আর তাকে যে জামিন দিয়েছে তাদেরকেও বিপাকে ফেলে। পরবর্তীতে দেখা যায় ক্রেডিটে কোন বোর্ড সদস্য আত্মীয় থাকলে তার ঋণ মঞ্জুর হতে কোন সমস্যা হয় না। আর তা না থাকলে সেই সদস্য বলে, আমাকে ঋণ দিচ্ছে না আর জমাই দিব না, হিসাব চালাবো না, আরো অনেক কিছু। তাদের বুঝাবে কে? বুঝানোর দায়িত্ব তো আমাদেরই। আমার বয়স যখন ১৫ তখন আমি বনপাড়া ক্রেডিট এর সদস্য হয়েছি। পরে ১৭ বছর বয়সে ঢাকায় চলে আসি আর ঢাকা ক্রেডিট এর সদস্য হই। অর্থাৎ আমি বনপাড়া ক্রেডিট এর সদস্য হয়েছি প্রায় ১০ বছর আগে আর ঢাকা ক্রেডিট এর সদস্য হয়েছি প্রায় ৭ বছর আগে। বনপাড়া ক্রেডিট এর বই বাড়িতে, বাড়ি থেকেই চালায়। আজকের হিসাব থেকে দেখা যায় ঢাকা ক্রেডিট এর শেয়ারের চেয়ে বনপাড়া ক্রেডিট এর আমার অর্ধেক জমা আছে। এর একমাত্র কারণ হচ্ছে গ্রামাঞ্চলে এখনো সর্বনিম্ন শেয়ার জমার যে ধারণা সেটা রয়ে গেছে। মাসের শেষে জমা দিব, সর্বনিম্ন ২০ টাকা হলেই হয়। আগামী দিনের জন্য কোন ভাবনা বা চিন্তা গুটি কয়েক মানুষের মধ্যে আছে কিনা সন্দেহ। এর কারণ সচেতনতার অভাব। অনেকে আবার বলে, ঢাকাতে ঋণ বেশী দেয় কিন্তু গ্রামে তো ঋণের পরিমাণ কম। আমার কথা হলো আমরা যদি শেয়ার না বাড়াই তাহলে ঋণ পাবো কিসের ওপর ভিত্তি করে? আর কয়েকজন সদস্যের টাকা দিয়ে তো আর ঋণের সিলিং বাড়ানো সম্ভব নয়। এর জন্য প্রয়োজন সকল সদস্যকে একত্রিত হয়ে কাজ করা। আমাদের ম্যানেজম্যান্ট কমিটিরও এখানে গাফলতি দেখা যায়। কোন সেমিনারে এই শেয়ার বৃদ্ধির বিষয়ে ভালমত যে ব্যাখা বা সদস্যদের বুঝানো তা আমি শুনিনি। আমার মতে পুরো একদিনের একটি সেশন হওয়া উচিৎ শেয়ার বৃদ্ধি আর বিভিন্ন প্রোডাক্ট নিয়ে।
বার্ষিক সাধারণ সভায় দেখি অনেকে অনেক ধরণের প্রশ্ন করে, আমার মনে হয় অনেকে প্রশ্নের জন্য প্রশ্ন করে বা বোর্ডকে দোষ দিতে প্রশ্ন করে। কিন্তু সমিতির গঠমূলক সমালোচনা খুব কমই দেখা যায়। আমাদের উচিৎ একসাথে সমিতির গঠনমূলক সমালোচনা করে সমিতিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। এর জন্য প্রয়োজন শিক্ষিত বা স্বশিক্ষিদের এগিয়ে আসা।
আমরা ক্রেডিটের নির্বাচনে অনেকেই বিভিন্ন পদের জন্য একে অন্যের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করি। অনেক সময় নিজেদের মধ্যে মনোমালিন্যের সৃষ্টি হয় যা কিনা দীর্ঘকাল ধরে রয়ে যায়। লক্ষ লক্ষ টাকা আমরা আমাদের পকেট থেকে খরচ করি। কে কেন এই টাকা খরচ কেও আমার সঠিক জানা নেই তবে আমার মনে হয় কেউ নিজেকে জাহির করার জন্য আবার কেউ কেউ নিজেকে নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য। তার মানে আমি কিন্তু বলছি না যে, কেউ সমাজ সেবার জন্য বা ক্রেডিটের উন্নয়নের জন্য কাজ করছে না। অবশ্যই কেউ কেউ সমাজ সেবার জন্য কাজ কিন্তু তার সংখ্যা খুবই সীমিত বলে আমার মনে হয়। কারণ ক্রেডিটের উন্নয়ন বা সমাজ সেবার জন্য আমাকে যে লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে নির্বাচন করতে হবে এমনটি কিন্তু কোথাও লেখা নেই। সমাজ যাকে মনে রাখে বা নেতা বলে মানবে তার কাছে অবশ্যই আসবে বা তাকে অবশ্যই সম্মান দেখাবে। আজকে আমরা যে টাকা খরচ করছি কথিত এই নির্বাচনে সেই টাকা দিয়ে একটা ফান্ড গড়ে তুলে যেখান থেকে কয়েকটি মেধাবী শিক্ষার্থীকে বৃত্তি দেওয়ার মাধ্যমে সমাজের বড় ধরণের পরিবর্তন আনা সম্ভব। অনেকে বলতে পােও আমি বড় বড় লেকচার দিচ্ছি হয়তো তাই। তবে হ্যাঁ, যে এই নির্বাচনের ব্যবস্থা আছে বলেই আমরা এটা করে থাকি আর এর জন্যই আমরা ভোট দিয়ে আমাদের ক্রেডিট নেতা নির্বাচন করি। আমার মতে ক্রেডিট নেতা হওয়া দরকার জণমূখী, সমাজ মূখী, কল্যাণকামী। কারণ ক্রেডিটের টাকা জনগণের। আর নেতারা শুধু এর অত্যাবধানের সুযোগ পেয়ে থাকেন তবে এতেও শর্ত হচ্ছে এই টাকার সঠিক ব্যবহার করে সমিতির সম্পদ উত্তোরোত্তর বৃদ্ধি করা।
মানুষ চাইলে সবই করতে পারে এর জন্য প্রয়োজন সদিচ্ছার। আমরা গরিব বলে আজ ক্রেডিট ইউনিয়নের সদস্য। আমরাতো চাইব ঋণ নিতে। নানা মিথ্যা তথ্য দিয়ে ঋণ একবার হাতে পেলে আর ঠেকায় কে? কারণ আমি তো বুঝি না এই ঋণের টাকা আমি কিভাবে ব্যবহার করবো? আমি কিভাবে এই ঋণ পরিশোধ করবো? আমাকে বুঝানোর দায়িত্ব ওই ক্রেডিট নেতাদের হাতে দিয়েই রেখেছি!
প্রতিটি ক্রেডিটে শিক্ষার নামে একটি ফন্ড গঠন করা থাকে। এর উদ্দেশ্য আমার মনে হয় সমাজের শিক্ষার্থীদেও জন্য ব্যবহার করার জন্য। শিক্ষা ঋণ বা বৃত্তির মাধ্যমে। এর বাইরেও করণীয় আছে। আমরা দেখি অনেক শিক্ষর্থী যখন নবম শ্রেণীতে ভর্তি হতে যায় তখন সে সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগে বিভাগ বাছাইয়ের ক্ষেত্রে। কারণ তারা বর্তমানে চাকরীর বাজার ও নিজের দুর্বলতাকে সঠিক ভাবে নির্নয় করতে পারে না। সাধারণ শিক্ষা না কারিগরির দিকে যাবে সেদিকেও তার যানে না। যেমনটি আমার ক্ষেত্রেও হয়েছে। আমাকেও কেউ কোন পরামর্শ দেয়নি। তাই আমরা বছেও অন্তত একটি সেমিনারের অর্থায়ন করতে পারি স্কুলে অষ্টম শ্রেণীতে পড়া শিক্ষার্থীদেও নিয়ে। যেখানে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক, শিক্ষার্থী, চাকরীজীবি এবং সফল উদ্যোক্তাগণ তাদের এই পর্যায়ে আসার গল্প বলবে, শিক্ষার্থীদের দিক নির্দেশনামূলক পরামর্শ দিবেন। আশা করি এটা অন্তত তাদের ভবিষ্যতে কাজে লাগবে এবং আমাদের ক্রেডিট ইউনিয়ন পাবে যোগ্য নেতা, যোগ্য সদস্য।
আমাদের সমাজের অনেক শিক্ষার্থীই ভবিষ্যতে অনেক বড় স্বপ্ন দেখে কিন্তু সামান্য সহযোগিতার অভাবে সেই স্বপ্ন পূরন অসাধ্য হয়ে পড়ে। সেটা অনেক সময় আর্থিক সমস্যা আবার পারামর্শ কিংবা কাউন্সিলিং এর অভাব। সমাজ মানেই মানুষ। সমাজের উন্নয়ন ঘটানোর জন্য সবার আগে সমাজের প্রধান উপাদার মানুষকে উন্নত করা মানসিক আর শিক্ষার দিক থেকে। কাউন্সিলিং এর মাধ্যমে তাদের স্বপ্নের কথা আমাদের শুনতে হবে। প্রয়োজনে এবং সামর্থ অনুযায়ী সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিতে হবে আমাদেরই। আর এই কাজটি করার জন্য ক্রেডিট ইউনিয়ন একটি যোগ্য প্রতিষ্ঠান। বেশি অর্থেও প্রয়োজন এই কাজগগুলো করার কিন্তু প্রয়োজন ইচ্ছার।