১৭ ই সেপ্টেম্বর ২০২০, দেশে করোনার প্রকোপ বেশি ছিল। এরই মধ্যে কারিতাস এর আয়োজনে দিনাজপুরে ৩ দিন ব্যাপি শিশু সুরক্ষা বিষয়ক প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণ করি। বিষয়গুলো এর আগে কখনো এই বিষয়ে এভাবে ভেবে দেখিনি। যাই হোক মূল কথায় আসি এবার, মানুষ হিসেবে আমরা ভুল করে শিখি বা ভুলটাই বারবার করি। আমরা এটাতে একটু বেশি পরিমাণেই অভ্যস্ত। শিশুরা হলো গাছের মত। গাছটিকে ছোট থেকে যত ভালোভাবে পরিচর্চা করা যাবে পরবর্তিতে তত ভালো ফল দিবে। আসে পাশে প্রায়ই বলতে শোনা যায়, আমার সন্তান মানুষ হলো না। পড়া—লেখা বা ভালো কোন কাজ করে না, সারা দিন ঘুরে বেড়ায় বা মা—বাবার কথা শোনে না।
আমরা হয়ত এইসব কথার সাথে খুবই পরিচিত। এই মূল সমস্যার শিকড় যদি খুঁজি তবে দেখা যাবে শিশু গর্ভে থাকা অবস্থায় বন্ধন ও পারপারিক স¤পর্কের অভাবই মূল কারণ। একটি শিশুর মাতৃগর্ভ থেকে যে গঠনবে সেটিই হবে পরবর্তী জীবন গঠনের জন্য ভিত্তি। আমরা হয়ত এই বিষয়গুলো কখনোই চিন্তা করি না। কিন্তু যখন একটি সন্তান গর্ভে থাকে তখন থেকেই মায়ের যত্ন নেয়ার মাধ্যমে শিশুর যত্ন নেয়াটা খুবই জরুরী। শুধুমাত্র ভালো খাবার বা পোশাক ভালো কিছু বয়ে আনতে পারে না। সেই সাথে দরকার স্বামী স্ত্রীর ও পরিবারের মধ্যে একটি ভাল স¤পর্ক যার মাধ্যেমেই শিশুর মধ্যে ভালো মূল্যবোধ জাগ্রত হয়। তারপর সন্তানদের অনেক আদর যত্ন দিয়ে আস্তে আস্তে বড় করতে থাকি। তখনই শুরু হয় আমাদের নানা সমস্যা। প্রথম দুই বছরের পারিবারিক শিক্ষাটা যে কত গুরুত্বপূর্ন তা হয়ত আমরা ওই সময়টায় বুঝি না। অনেক কিছু করে ফেলি যা থেকেই শিশুদের মধ্যে মানসিক চাপ আসে। শিশুদের যেসব কথা বলা থেকে সচেতন ভাবে দূরে থাকা দরকার:
১. এখনি খেয়ে নাও, নাহলে এসে তোমার খাবারটা খেয়ে নিবে বা তোমার খেলনা নিয়ে যাবে।
২. শিশু কখনো পড়ে গিয়ে থাকলে বা কোনো কিছুর সাথে আঘাত পেয়ে থাকলে; উফফ পড়ে গিয়েছ, আসো ফ্লোর টা দুষ্ট, ওকে মেরে দেই।
৩. তুমি খাচ্ছো না, তাহলে তোমাকে কোলে নেবো না, আদর করবো না, আমি অমুক কে আদর করবো।
৪. খাও তাহলে মোবাইল এ কার্টুন দেখাবো। এরকম অনেক কথাই আমরা রোজ শিশুদের বলে থাকি। কিন্তু একবারও ভাবিনা এসব কথা তার মন:স্তত্ত্বে কি বিশাল ক্ষতি ডেকে আনতে পারে। তাকে হিংসুটে, প্রতিযোগিতাপরায়ন,হিংস্র করতে পারে,হীনমন্যতা, হতাশা, আত্নবিশ্বাসের অভাবে ফেলতে পারে। শিশুকে খাদ্য গ্রহণ বা যেকোন বিষয়ে এইরকম প্রচলিত কথা বলা থেকে বিরত থাকা প্রয়োজন,বরং তাকে নানান ইতিবাচক কথা বলে উৎসাহী করতে হবে। তাকে প্রকৃতি, ফুল, প্রজাপতি, নদী, মানুষ, নানান মজার রূপকথার গল্প বলুন, পাখি বা কোনো প্রাণীর গল্প বলুন। আপনার রোজকার, কর্মকান্ডের সাথে জড়িত গল্প বলুন আনন্দ নিয়ে। ধীরে ধীরে তার সেসবের প্রতি আগ্রহ বাড়বে। সে মজা পাবে, কল্পনা শক্তি প্রখর হবে। এক দুই বেলা কম খেলে তেমন কোনো স্বাস্থ্য ঘাটতি হবেনা। কিন্তু শিশুর কোমলমতি মন:স্তত্ব বিকৃত হলে ভবিষ্যৎ খুব কঠিন হবে তার এবং সমাজের উভয়ের। এখন হয়ত অনেকেই লিখাটি পড়তে পড়তে মনে হতে পারে এ ছাড়া তো আর কোন উপায় নেই। এত সময় কোথায়? সবাই টাকা পয়সা বাড়ি গাড়ি, সামাজিক বা রাজনৈতিক ক্ষমতার পিছনেই বেশী মনোযোগী। কিন্তু আমারা আমাদের আসল সম্পদ যে কোনটি সেটাই হয়ত ভুলে যাচ্ছি। সন্তানের ভবিষ্যতের জন্য বাড়ি, জায়গা—জমি, টাকা পয়সা আরো অনেক কিছুই করতে চাই। কিন্তু তারা কি চায় সেটা কি ভেবে দেখেছি? বড়দের মাঝে ছোটদের কথা বলতে নেই। কোন কিছু ভুল করে ফেললে শাস্তি বা অতিরিক্ত শাসন করে থাকি। কিন্তু তাদের কথা কখনো কি গুরুত্ব দেই? যদি কোন সময় আমরা ভুল করি
তখন কি আমরা তাদের কাছে দু:খ প্রকাশ করি? সাধারণ ভাবে উত্তর হবে ্য়ঁড়ঃ;না্য়ঁড়ঃ;এখনই সময় এই বিষয় গুলো ভাবার। আমরা উপদেশ দিতে অনেক ভালোবাসি কিন্তু এই উপদেশ বাণীগুলো যদি নিজের জীবনে না কাজে লাগাইয়া তবে আমাদের সন্তানরা কিভাবে শিখবে?
এই বার আসা যাক শিশুদের অধিকারের ব্যপারে। আগে জানতে হবে শিশু অধিকার কি? একটি শিশুর সুন্দর সুস্থ পরিবেশের মধ্য দিয়ে মনােদৈহিকভাবে স্বাবলম্বী হয়ে ওঠার জন্যে যে সকল অধিকারের প্রয়োজন তাকে শিশু অধিকার বলে। জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদ অনুযায়ী ১৮ বছরের কম সকল মানবসন্তানই শিশু হিসেবে বিবেচিত। শিশুরা জাতির ভবিষ্যৎ, তারাই ভবিষ্যতে জাতিকে নেতৃত্ব দেবে এটা সম্ভবত সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত এমন একটা বাক্য, যার বিপরীতে আমরা খুব কম জানি, আমাদের করণীয় কী। বাংলাদেশ ১৯৯০ সালে জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদে অনুস্বাক্ষর করার পর রাষ্ট্রীয়ভাবে কাঠামোগত অনেক উদ্যোগ নেওয়া হলেও সামাজিক চর্চায় শিশু অধিকারের বিষয়টি এখনো অনেকখানি উপেক্ষিত। এখনো আমাদের অধিকাংশের ধারণা, শিশুরা যেহেতু বয়সে ছোট, তাদের দাবি আদায়ের ক্ষমতা যেহেতু কম, তাদের সংগঠিত হওয়ার সুযোগ কম, অন্নবস্ত্র সবকিছু পরিমাণে তাদের কম লাগে বলে তাদের অধিকারগুলোও বোধ হয় মর্যাদায় তুলনামূলক ছোট এবং তা বাস্তবায়নে তেমন কোনো জবাবদিহি নেই। কিন্তু এই ধারণা স¤পূর্ণ ভুল। তারা শারীরিক—মানসিক স্বাস্থ্যের শিক্ষায়, চিন্তা চেতনায় ও মননে যত সমৃদ্ধ হবে জাতির ভবিষ্যৎ তত শক্তিশালী হবে। কিন্তু বাংলাদেশের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে শিশুদের সার্বিক পরিস্থিতি আশাব্যঞ্জক নয়। দারিদ্যের্র কশাঘাতে বহু শিশু তাদের বেঁচে থাকার অধিকার, বিকাশের অধিকার, জীবনযাত্রার মান ভাগে ও বিনাদেনের অধিকার ইত্যাদি থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে অভিভাবকরা অভাবের তাড়নায় তাদের শিশুদের ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়াগে করছেন। আবার ছিন্নমূল শিশুরা পেটের তাগিদে নিজেরাই টোকাই হচ্ছে, ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়ােজিত হচ্ছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে নানা অপরাধেও জড়িয়ে পড়ছে। শিশুদের এমন অবস্থায় আইন আছে, সরকারি—বেসরকারি ও আন্তর্জাতিক সনদ এবং প্রতিশ্রুতি আছে কিন্তু এগুলো প্রতিপালিত হচ্ছে না। জাতিসংঘের শিশু অধিকার সনদে যেসব অধিকারের কথা বলা হয়েছে তা হলো—
১. শিশুর বেঁচে থাকার অধিকার, যেমন— স্বাস্থ্যসেবা, পুষ্টিকর খাবার, বিশুদ্ধ পানি ও স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ।
২. বিকাশের অধিকার, যেমন: শিক্ষার অধিকার, শিশুর গড়ে ওঠার জন্যে উপযুক্ত একটি জীবনযাত্রার মান ভােগের অধিকার, অবকাশযাপন, বিনাদেন ও সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে অংশগ্রহণের অধিকার।
৩. সুরক্ষার অধিকার, যেমন: শরণার্থী শিশু, পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন শিশু, শাসন, নির্যাতন ও অবহেলার শিকার হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে এমন শিশু।
৪. অংশগ্রহণের অধিকার, যেমন শিশুদের স্বাধীনভাবে কথা বলার অধিকার, অন্যান্যের সঙ্গে অবাধে স¤পর্ক গড়ে তালোর অধিকার এবং তথ্য ও ধারণা চাওয়া—পাওয়ার অধিকার।
আমাদের বিভিন্ন পর্যায় থেকে প্রতিষ্ঠান, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বা সমাজের বিভিন্ন পর্যায় থেকে শিশু অধিকার সনদের আলাচ্যে সুবিধাগুলাতে আমাদের শিশুরা পাচ্ছে কি না তা ভেবে প্রয়োজেনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত। কারণ আমাদের অধিকাংশ শিশু তাদের প্রয়োজনীয় অধিকার পায় না। এমন অবস্থায় জাতির ভবিষ্যৎ বিনির্মাণে সবাইকে একটা ঐকমত্যে আসতে হবে। তাহলেই কেবল আমাদের শিশুরা তাদের ন্যায্য অধিকার পাবে।
জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদের চারটি মুলনীতি রয়েছে। সেগুলো হলো :
১। বৈষম্যহীনতা
২। শিশুর সর্বোত্তম স্বার্থ
৩। শিশুদের অধিকার সমুন্নত রাখতে পিতা—মাতার দায়িত্ব ও
৪। শিশুদের মতামতের প্রতি সম্মান প্রদর্শন।
এই সকল সনদের প্রতি যদি আমরা একটু সম্মান বা নজর দেই তবে আমাদের শিশুদের জন্য একটা সুন্দর ও উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ দেখতে পাবো। শিশুদের সঠিক গঠনের জন্য আমাদের ছোট ছোট কাজ বা অভ্যাসই যথেষ্ট:
১) পারিবারিক ও ব্যক্তিগত সমস্যা থেকে শিশুদের দূরে রাখা।
২) নেশাগ্রস্থ অবস্থায় তাদেরকে কাছে না নেয়া।
৩) প্রত্যেক শিশুকে বাইরে খেলাধুলা করার সুযোগ করে দেয়া।
৪) যৌন নির্যাতন বা প্রযুক্তি ব্যবহারের খারাপ দিক সম্পর্কে সচেতন করা।
৫) শিশু বা সন্তানের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কে গড়ে তোলা।
৬) বিভিন্ন ভালো কাজে তাদের উৎসাহিত করা বা তাদের প্রাপ্য সম্মান দেয়া।
৭) শিশুকে ছোট করা বা কটু কথা না বলা।
৮) শিশু বা সন্তানের কাছে দু:খ প্রকাশ করা ইত্যাদি কাজের মাধ্যমেই আমরা পরিবারে, সমাজে শিশুদের ভবিষ্যৎ গড়তে পারবো। আগামীদিনের শিশুদের ভবিষ্যৎ আপনার আমাদের সকলের হাতেই। আমাদের সচেতনতার মধ্য দিয়েই শিশুদের জন্য এক নতুন পৃথিবী সৃষ্টি করতে পারবো।