কোমল কচি ছোট হাত দুটি সুকেশের ড্রয়ারের হ্যান্ডেলে ডুকিয়ে সজোরে টানতে থাকে নক্শী। বার কয়েক চেষ্টা করতেই বেরিয়ে আসে ড্রয়ারটি। উদ্দেশ্যহীনভাবে ড্রয়ারে রাখা কাগজপত্রগুলি নাড়া চাড়া করতে করতে বড়দিনের পুরানো শুভেচ্ছা কার্ডগুলি হাতে পড়ে। কার্ডগলি দেখেই মনে ভাবনা এলো নিজেই কিছু কার্ড বানানোর চেষ্টা করবে সামনে বড়দিন তাই সুন্দর হলে কাউকে দিবে। ভাবতে ভাবতে আরও কিছু বইপত্র নাড়াচাড়া করতেই একটি গোলাপি রঙ্গের বই নজরে পড়ে। বইটি তার কাছে কৌতুহলের বিষয় হয়ে উঠল কারণ বইয়ের উপর সুন্দর অক্ষরে তার নাম নক্শী লেখা রয়েছে। কিন্তু বইটি কিসের তা সে বুঝতে পারলো না কারণ তার এখনও বোঝার বয়স হয়নি। সবে মাত্র দ্বিতীয় শ্রেনীতে পরীক্ষা লিখেছে নক্শী। সে বইটি হাতে নিয়ে দৌড়ে ছুটে যায় মায়ের কাছে। মাকে বইটি দেখিয়ে জিজ্ঞাসা করে, “মা এটি কি বই? মা শিশু কিশোর বই দেখে বলেন, এইটি তোমার শিশু কিশোর বই। তোমার বইটা ঠিক জায়গায় রেখে এসো নইলে হারিয়ে যাবে।” নকশী একটু ভেবে আবার মাকে প্রশ্ন করতে থাকে, এটা দিয়ে কি হয় আমার নাম লেখা কেন ইত্যাদি। মা সিমু তাকে এই প্রকল্প সমন্ধে যেটুটু বুঝেন সেটুটু মেয়েকে বুঝিয়ে বলেন। মা আরো বলেন যে, তুমি যখন বড় হবে তখন তোমার কাজেই লাগবে। নক্শী বলল, “ বইটা আমার কাছে রাখি আর আমি জমা দেই।” মা রাজি হয়ে মেয়েকে উৎসাহিত করেন।
নক্শী স্কুলে যাওয়ার সময় বাবা পাঁচ দশ টাকা দেন টিফিন খাওয়ার জন্য। ছোট নকশীর মাথায় বুদ্ধি এলো যে প্রতিদিন টিফিন না কিনে না খেয়ে টাকা জমা করতে লাগলো। এই জমানো টাকা সে গীর্জায় আনার সময় ঋণদান অফিসে গিয়ে জমা দিয়ে আসে। নকশীর কাকু, পিশি, মাসী মামা আছে। তারা মাঝে মধ্যেই নক্শীকে আদর করে কিছু টাকা দেয়। তাছাড়া বড়দিনে প্রণাম করেও বেশ কিছু টাকা পায়। সে টাকা গুলিও সে তার বই এ জমা করে। এভাবে দিন যায় মাস আসে নক্শীও বড় হতে থাকে। তার মনে বড় একটা আশা গোপন করে রেখেছে ছোট বেলা থেকেই। সে তার মায়ের সেলাই মেশীনে পাড়া প্রতিবেশীদের ছোট খাট সেলাই করে কিছু উপার্জন করে তাছাড়া আরো কিছু হাতের কাজ যেমন উলের তৈরী ছোট জিনিস ও কাগজের তেরী বিভিন্ন ধরনের ফুল ইত্যাদি তৈরী করে তা বিক্রি করে কিছু কিছু টাকা জমা করতে লাগল। লেখা পড়ায় সে ভাল। ঝ.ঝ.ঈ পাশ করে সে ঐ.ঝ.ঈ তে ভর্তি হয়ে পাড়ার কিছু ছেলে মেয়েদের প্রাইভেট পড়াতে থাকে।
কালে প্রবাহে দিন মাস বছর পেরিয়ে আঠারো বছর বয়সে পরিণত হয় নক্শী। ইতিমধ্যে ঝ.ঝ.ঈ তে জি.পি.এ ফাইভ পেয়ে সকলের মনটা আকৃষ্ট করে সে। নকশী নামের সাথে রয়েছে কাজের মিল। যেমন তার গুন তেমনি রূপ। বিধাতা যেন নিজ হাতে সুনিপুনভাবে তার চোখ, নাক, মুখ, ঠোট গড়িয়ে দিয়েছেন। তাই বয়স হতে না হতেই চারদিক থেকে আসতে থাকে বিয়ের প্রস্তাব। বাবা মেয়েকে বিয়ে দেওয়ার জন্য চাপ সৃষ্টি করতে থাকে। কিন্তু নক্শী বিয়েতে একদম নারাজ। তার পড়া লেখা করার প্রচুর ইচ্ছা কিন্তু নি¤œবিত্ত পরিবারের বাবা ভাবছেন তার ছোট আরো দুটি ছেলে রয়েছে। মেয়েকে পড়াতে চাইলে ছেলেদের ব্যয়ভার বহন করতে পারবেন না। তাই মেয়েকে পড়ানোর ভাবনাটা মাথা থেকে বের করে দিয়েছেন। কিন্তু নকশী তার ছোট বেলার সেই আশাটা পূর্ন করতে আপ্রান চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। সে তার মাকে ‘শিশু কিশোর’ বইটি দেখিয়ে বলে, মা দেখ আমার বইয়ে কত টাকা জমা হয়েছে? মা খুব বেশী পড়া লেখা জানে না। তবুও বইটা দেখে আনন্দে বলে উঠে তুমি কিভাবে এত টাকা জমিয়েছ? হ্যাঁ, আমি দেখেছি তুমি অনেক কিছু করতে চেষ্টা করেছ এবং পেরেছ। তাই বলে এত টাকা জমাতে পারবে আমি ভাবতে পারিনি। নকশী হেসে বলে হ্যাঁ মা প্রায় আশি হাজার টাকা। তোমরা আমাকে ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার পড়াতে না পারলেও আমাকে ভাল কোন জায়গায় পড়াশুনার সুযোগ করে দাও।” মা বলেন, হ্যাঁ মা আমি আর তোমার বাবা কালই যাবো তোমার স্যারদের সাথে আলাপ করে দেখি তোমাকে কোথায় ভর্তি করানো যায়। আমারা তোমাকে সহযোগিতা করব।” মা শিমু তার দুই ছেলেকে ডেকে পরামর্শ দেন যেন ওরা কবুতর হাঁস মুরগী পালন করে বাড়ীর আঙ্গীনার আশে পাশে সবজী চাষ করে শিশু কিশোর সঞ্চয়ে টাকা সঞ্চয় করে। ঋণদান বিপদের বন্ধু জীবনগড়ার সিন্দুক।