রাজুর (ছদ্ম নাম) মনটা খুব খারাপ।
বাড়ি থেকে ফোন এসেছিলো, ঋণদান সমিতি থেকে লোক দিয়েছিলো। তার সমবায় সমিতির বই এ গত মাসে কিস্তি দেওয়া হয় নাই। তাই তাদের বাড়িতে মিটিং এ বসেছিলো। রাজুর কাছে কেউ কখনো কোন টাকা পায় না। শুধু ক্রেডিট ইউনিয়নে ঋণ রয়েছে। একটি বড় হোটেলে বাবুর্চির চাকরী করে সে। এ পর্যন্ত সে এই সমবায় সমিতির সদস্য হয়ে অনেক কিছু করেছে। বাড়ি করেছে। জমি কিনেছে। বিয়েও করেছে ঋণের টাকায়। তবে এখন কোন ব্যক্তি তার কাছে থেকে কোন টাকা পয়সা না পেলেও সমবায় সমিতিগুলো ঠিকই তার কাছ থেকে টাকা পায়। ৬টি সমিতিতে তার ঋণ এর পরিমাণ প্রায় ৫ লক্ষ টাকা। এগুলোর জন্য প্রতি মাসে তাকে কমপক্ষে ১৫ হাজার টাকা কিস্তি দিতে হয়। সে জানে তার ঋণ দিন দিন কমছে। কিন্তু সে আর পেরে উঠছে না। দ্রব্য মূল্যের উর্ধ্বগতি, বাড়ি ভাড়া বৃদ্ধি, বাস ভাড়া বৃদ্ধি, খাবার দরব সব মিলিয়ে সে প্রতি মাসে দৈনিক খরচ নির্বাহ করতে হিমসীম খায়। তার গ্রামে বাবাকে চিকিৎসার টাকা দিতে হয়। ছোট বোনটার কলেজের বেতন, স্ত্রী সন্তানের চাহিদা তো রয়েছেই। ২৫ হাজার টাকা বেতনে চাকরী করে সে প্রতি মাসেই হা হুতাস করে। পকেটে টাকা থাকে না। মাস শেষ হওয়ার আগেই তাকে কারো না কারো কাছ থেকে টাকা ধার করতে হয়।
অন্তু রোজারিও (প্রকৃত নাম নয়) মাঝে মাঝে আত্ম হত্যার কথা চিন্তা করে। ছাদে গিয়ে একা একা কাঁদে। তাকে সান্ত্বনা দেওয়ার কেউ নাই। এই পৃথীবির সবাই যেন চরম স্বার্থপর। অন্তু একটা বিদেশী কোম্পানিতে চাকরী করে। মাইনে ভালই। ৩০ হাজার টাকার মত পায়। কিন্তু তার সমবায় সমিতিতে ঋণ, পারিবারের সদস্যদের চাহিদা মেটাতে গিয়ে সে হিমসীম খাচ্ছে। তার স্ত্রী তার সাথে ঢাকাতেই থাকে। বিয়ে, চিকিৎসা ও আসবাবপত্র কিনতে গিয়ে সে ৮টি সমিতিতে ঋণ করেছে। ঋণ তোলার সময় সব সমিতিতেই সে ৩০ হাজার টাকা আয় দেখিয়েছে। সব জায়গা থেকেই সে ঋণ পায়। কিন্তু এখন তার ৮ লক্ষ টাকার ঋণ এর কিস্তি চালাতে গিয়ে মাস শেষে দম বন্ধ হয়ে যাওয়ার অবস্থা।
“বৌ—বাচ্চার চাহিদা পূরণ করতে পারবে না তো বিয়ে করেছিলে কেন?” চিৎকার করে জানতে চায় অন্তুর স্ত্রী। অন্তু অসহায়ের মত শুধু স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে থাকে। সে স্ত্রীর চাহিদা পূরণে আরো বেশি ধার দেনা করে। একটা সমিতির বই এ ঋণ পরিশোধ হলে আরেকটা থেকে ঋণ তোলে। এভাবে সে একের পর এক ঋণের সাথে জড়িয়ে পড়ছে। মাস শেষে গিয়ে ঋণ এর টাকা পরিশোধ করতে গিয়ে তার কান্না পায়। সব থেকে বেশি খারাপ লাগে যখন কোন সমিতিতে দুই তিন মাস কিস্তি দিতে পারে না তখন সেই সমিতি থেকে চিঠি পায় বা তার কাছে অফিস থেকে লোক যায় তখন। তার আরো বেশি খারাপ লাগে যাদিও শেয়ার জামিন নিয়ে সে ঋণ করেছিলো, তাদের বই ডিফল্ট হওয়ায় জামিনদাররা ফোন করে বকা দিলে।
অন্তুর বাবা তার উপর ভীষণ অখুশি। সে বাবাকে প্রতি মাসে গ্রামে টাকা পাঠাতে পারে না। তার বাবা ভাবছেন ছেলে তাদেরকে অবহেলা করছে। মানুষের মুখে শুনেন ছেলে এত টাকা কামায় করে, তার প্রশ্ন সেই টাকা কোথায় যায়? ছেলে নিশ্চয়ই তার শ্বশুরবাড়িতে টাকা পয়সা দেয় ইত্যাদি ইত্যাদি। রাজু, অন্তুর মত হাজার হাজার সমবায় বা ঋণদান সমিতির সদস্য যারা ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে হা হুতাশ করছেন। অনেকে আত্ম হত্যার কথাও চিন্তা করেন। ফাদার চালর্স জে ইয়াং পঞ্চাশ দশকে খ্রীষ্টান সমাজে সমবায় আন্দোলন প্রবর্তন করেছিলেন। তারই ধারাবাজিকতায় আজ দেশের খ্রীষ্ট মন্ডলীতে প্রায় প্রতিটি চার্চে বা মন্ডলী সমবায় সমিতি বা ক্রেডিট ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ঢাকায় এখন প্রতিটি এলাকা ভিত্তিক রয়েছে একাধিক সমিতি। সমবায় সমিতি অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি আনে তা নিঃসন্দেহে বলা যায়। তবে এখন সমিতির পরিমাণ অতিরিক্ত হওয়াটাও অনেকে সমস্যা মনে করছেন। ঋণ বিতরণে আরো কড়াকড়ি হওয়া, ঋণ গ্রহনে উচ্ছুক ব্যক্তির আয়ের উৎস সম্পর্কে সরেজমিনে গিয়ে তথ্য নেওয়া, ঋণ গ্রহনে উচ্ছুক ব্যক্তিদের অন্যান্য সমিতিতে ঋণ ঠিক মত পরিশোধ করছে কিনা তা যাচাই করা, সমিতিতে স্বজন প্রিয়তা দূর করে ঋণ দেওয়া ইত্যাদি মানুষের ঋণের বোঝা কমাতে পারে বলে মনে করছেন সমবায়ী বিশেষজ্ঞগণ। এছাড়া অপচয় হ্রাস, আয় অনুসারে ব্যয় করে এবং ভবিষ্যতের জন্য সঞ্চয় করার অভ্যাস করলে ঋণের বোঝা কমনো যায়।
রাজশাহী ধর্মপ্রদেশের বিশপ জের্ভাস রোজারিও তার পালকীয় পত্রে ধর্মপ্রদেশের বেশ কয়েকটি সমস্যা বা চ্যালেঞ্জের মধ্যে ঋণ এর বোঝাকেও উলেখ করেছেন। সেখানে তিনি বলেছেন, অতীতে প্রধান সমস্যা ছিল অর্থনৈতিক অভাব, অনটন, স্বামী—স্ত্রীর মধ্যে বোঝাপড়ার অভাব…। নতুন সমস্যার মধ্যে তিনি যোগ করেছেন ১) খ্রীষ্টবিরুদ্ধ সংস্কৃতি… ৬) অর্থনৈতিক চাপ ও অপব্যয়ের অশুভ প্রতিযোগিতা— অতিরিক্ত ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়া। এই ‘অতিরিক্ত ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়া’ থেকে কিভাবে মুক্তি পাওয়া যায় সে জন্য সচেতন মহলকে ভাবতে হবে। নয়ত এই ঋণের সমুদ্রে হাজার হাজার মানুষ হাবুডুবু খেয়েই যাবে। সমবায়ী আন্দোলনের প্রকৃত উদ্দেশ্য ব্যহত হবে।
– সুমন কোড়াইয়া
লেখক: সাংবাদিক ও উন্নয়ন কর্মী