আর্থিক ঋণসেবা প্রক্রিয়ায় ক্রেডিট ইউনিয়নের বিশেষত্ব

বিশ্ব ব্যাংকের গবেষণা অনুযায়ী আর্থিক সেবাদান প্রক্রিয়ায় চারটি প্রধান বৈশিষ্ট্য অন্য সব ক্ষুদ্রঋণ প্রকল্প/সংগঠন/প্রতিষ্ঠান থেকে ক্রেডিট ইউনিয়নকে বিশেষত্ব দান করেছে। ক্রেডিট ইউনিয়নের কার্যক্রমের প্রধান চারটি চালিকাশক্তি হল:

১. সদস্যদের পেশাগত বৈচিত্রতা এবং সেবার বহুবিধ সমাহার,

২. মূলধন বৃদ্ধির চলমান প্রক্রিয়া,

৩. আর্থিক সঞ্চয়ের আবর্তন এবং

৪. বহুমূখী ঋণকার্যক্রম।

১) সদস্যদের পেশাগত বৈচিত্র্য এবং সেবার বহুবিধ সমাহারঃ 
ক্রেডিট ইউনিয়নের সদস্যদের মধ্যে রয়েছে পেশাগত বৈচিত্র্য। শহর এলাকার সদস্যগণ নির্মাণ কমীর্, দিন মজুর, শ্রমিক, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, শিক্ষক, ডাক্তার, উকিল, গৃহিণী, পোশাক শ্রমিক, বিউটিশিয়ান, এনজিও কর্মী, চাকরিজীবী, সরকারী কর্মচারী—কর্মকতার্, ব্যাংক কর্মকর্তা কিংম্বা ছাত্র অথবা আত্ম—কর্মসংস্থান নির্ভর। গ্রাম এলাকার সদস্যগণ হতে পারে কৃষক, শ্রমিক, দিনমজুর, জেলে, মুদিদোকানী, কাঠমিস্ত্রি, হস্তশিল্পী, কুঠিশিল্পী, ব্যবসায়ী, ছাত্র—ছাত্রী, শিক্ষক, প্রবাসী চাকরিজীবী, মহাজন অথবা স্বল্প আয়ের লোকজন।

বিচিত্র পেশার সদস্যদের উপস্থিতি ক্রেডিট ইউনিয়নের ঋণ কার্যক্রম ঝুঁকি হ্রাস করে । সদস্যদের নানাবিধ চাহিদা অনুযায়ী বিচিত্র ধরণের আর্থিক সেবাদানের মাধ্যমে অর্থনৈতিক এবং আর্থ—সামাজিক উন্নয়নে ধর্মপল্লী ভিত্তিক ও ক্ষুদ্র সমাজভিত্তিক ক্রেডিট ইউনিয়ন মূখ্য ভূমিকা পালন করে । ক্রেডিট ইউনিয়ন শুধুমাত্র গরীব বা স্বল্প আয়ের লোকদের আর্থিক সেবাদানের লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত বা শুধুমাত্র গরীবদের জন্য কাজ করে তা নয়, রবং সমাজের সর্বস্তরের মানুষের চাহিদা মাফিক আর্থিক সেবা প্রদান করে যাতে স্ব স্ব অবস্থানে সকলের সর্বাধিক আর্থিক চাহিদা পূরণ হয়। ফলে সমাজের অর্থনৈতিক ভিত্তি মজবুত হয় এবং গোটা সমাজ আর্থিক স্বাবলম্বী হয়ে সার্বিক উন্নয়নের সমন্বয়ে জীবনযাত্রার মান উন্নত হয়। এতে ধীরে ধীরে ধনী—গরীব, ঋণগ্রহীতা—মহাজনশ্রেণির মধ্যকার দূরত্ব হ্রাস পায়, বরং সকলে সকলকে আর্থিক সেবা প্রদান করে থাকে। ধনী ও মহাজনশ্রেণির অতিরিক্ত অর্থ বিনিয়োগ করে গরীব ও ঋনগ্রহীতাদের চাহিদা পূরণ করে আবার ধনী ও মহাজনশ্রেণি তাদের বিনিয়োগের বিপরীতে আকর্ষনীয় আর্থিক মুনাফা ভোগ করে থাকে। এতে সমাজে নতুন উদ্যোগক্তাশ্রেণির আগমন ঘটে যারা আকর্ষনীয় এবং চাহিদা মাফিক নতুন ভোগ্যসামগ্রী উৎপাদন করে নিজের ও সমাজের জীবনযাত্রার মান উন্নত করে থাকে।

২) মূলধন বৃদ্ধির চলমান প্রক্রিয়াঃ 
ক্রেডিট ইউনিয়ন ক্ষুদ্র ঋণগ্রহিতা বা সংগঠকদের অত্যন্ত মিত্যাচারী এবং সততার সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠতে সহযোগিতা দেয় কিন্তু গতিশীল হারে সম্পদ বৃদ্ধি এবং আয়ের নিরাপত্তা বিধান করে। সদস্যদের পারস্পরিক ঋণ আদান—প্রদান সম্পর্ক মাধ্যমে আয়ের উৎস সৃষ্টি হয় এবং মূলধনের সঠিক ব্যবহার মধ্য দিয়ে মুনাফা অর্জন করে। সদ্যসগণ ব্যবসায় বিনিয়োগের মাধ্যমে অর্থ উপার্জন করে এবং সঞ্চয় করতে আগ্রহী হয় ফলে সম্পদ বৃদ্ধি পায়। এভাবে ক্রেডিট ইউনিয়ন স্বল্প আয়ের ক্ষুদ্র সমাজের সদস্যদের মূলধন গড়তে সহযোগিতা করে। ক্রেডিট ইউনিয়নভুক্ত সদ্যসদের আর্থিক উন্নয়ন দেখে নতুন সদস্য ক্রেডিট ইউনিয়নের প্রতি আগহী হয় এবং তারাও তাদের বাড়তি আয় সঞ্চয় করে এবং ঋণ গ্রহণ করে আয় বৃদ্ধি করে। ঋণ আদান—প্রদান প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নিজেদের মাঝে আর্থিক সেবার বিনিময় ঘটে। এভাবে সদস্যগণ সুষ্ঠ এবং সফল ঋণ কার্যক্রম ইতিহাস সৃষ্টি করে, ব্যক্তিগত ঋণ ব্যবহার করে ঋণ কার্যক্রম গতিশীল রাখে এবং মূলধন বৃদ্ধি পায়।

ক্রেডিট ইউনিয়ন ঋণগ্রহীতাগণ সাধারণত ঋণের অর্থ পরিবারের বাড়তি আয় উপার্জনের ক্ষেত্রে ব্যবহার করে থাকে। আয় বৃদ্ধির সাথে সাথে তাদের বিনিয়োগের নতুন ক্ষেত্র সৃষ্টি হয় এবং উপার্জনের সুযোগ ঘটে ফলে সাশ্রয়ী সুদে ও সহজ ফেরত পদ্ধতিতে ব্যবসা ও পরিবারের চাহিদা পূরণের জন্য বড় অংকের অর্থ ঋণ গ্রহণ করে । প্রাথমিক পর্যায়ে অর্থ সঞ্চয়ে সদস্যদের আগ্রহ খুবই কম থাকে, তাদের আগ্রহ থাকে ঋণ গ্রহণ। কিন্তু ঋণের অর্থ ব্যবহার করে বাড়তি আয় হয় এবং সম্পদের পরিমান বাড়ে তখন তারা কম ঋণ গ্রহণ করে এবং অতিরিক্ত অর্থ সঞ্চয়ে আগ্রহী হয়। সদস্যগণ তখন প্রকল্প ঋণ গ্রহণ করে অধিকতর বেশী উপার্জনের জন্য অর্থ বিনিয়োগ করে থাকে। ক্রমান্বয়ে ঋনের চেয়ে সঞ্চয়ে আগ্রহ বেশী থাকে। ফলে প্রকৃত সঞ্চয়ী সংখ্যা বৃদ্ধি পায় এবং বিভিন্ন প্রকার সঞ্চয় স্কীমে বিনিয়োগ করে এবং আকর্ষণীয় আর্থিক মুনাফার সুবিধা গ্রহণ করে থাকে। এই প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকলে ঋণ এবং সঞ্চয় কার্যক্রমের আবর্তনের মাধ্যমে ক্রেডিট ইউনিয়নের মূলধন বৃদ্ধি পায়। ক্রেডিট ইউনিয়ন সদস্যদের চাহিদা ও প্রয়োজন অনুযায়ী আর্থিক সুযোগ সুবিধা প্রদান করে শুধু সাময়িক দারিদ্র্য বিমোচনে ভূমিকা রাখে না বরং জীবনযাত্রার মানে টেকসই উন্নয়ন আনয়ন করে। ফলে সমাজ ও দেশের অর্থনীতি উন্ন্য়নে সরাসরি দায়িত্ব পালন করে থাকে। সমাজে ধনী—দরিদে্র্যর দূরত্ব হ্রাস পায়, সমাজিক জীবনে সহাবস্থানের মাধ্যমে সম্পদের সুষ্টু বন্টন নিশ্চিত হয়।

৩) আর্থিক সঞ্চয়ের আবর্তনঃ 
ক্রেডিট ইউনিয়ন গবেষকদের মতে গ্রামের লোকদের নিকট ঋনের চেয়ে বরং সম্পদের তারল্য বেশী প্রয়োজন। একইভাবে আর্থিক চাহিদা পূরণের জন্য ঋণ যেমন প্রয়োজন তেমনীভাবে সঞ্চয়ের আবর্তনও গুরুত্বপূর্ণ। সেই জন্য ক্রেডিট ইউনিয়ন অন্য সকল প্রকার ক্ষুদ্র ঋণ কার্যক্রমে জড়িত আর্থিক বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান থেকে আলাদা কারণ ক্রেডিট ইউনিয়ের রয়েছে বিপুল পরিমান আবশ্যিক ও ঐচ্ছিক ক্ষুদ্র সঞ্চয় এবং আবর্তনের ব্যাপক ক্ষমতা। বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতার জন্য যে সমস্ত স্বল্প আয়ের জনগণ ব্যাংক অথবা বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানের নিকট সঞ্চয় জমা রাখতে পারে না ক্রেডিট ইউনিয়ন তাদের অতিরিক্ত অর্থ সহজ শর্তে গ্রহণ করে এবং বিনিয়োগ করে সর্বাধিক আর্থিক মুনাফা নিশ্চিত করে। কারণ ক্রেডিট ইউনিয়নের মালিক হিসেবে সদস্যরাই নিজেদের সকল প্রকার প্রতিবন্ধকতা দূর করে নিজেদের সুবিধা অনুযায়ী অর্থের নিরাপত্তা ও সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করে আর্থিক সুবিধা ভোগ করে থাকে।

ক্রেডিট ইউনিয়ন সঞ্চয়সমূহ জীবনযাপনের নানামূখী ক্ষেত্রে বিনিয়োগ করে থাকে যেন বিনিয়োগ থেকে সামাজিক উন্ন্য়ন ঘটে। যেমন — গৃহ নিমার্ণ, নিত্য ব্যবহার্য দ্রব্য উৎপাদনে নতুন উদ্যোগক্তা সৃষ্টি, নিত্যদিনের চাহিদা মাফিক ক্ষুদ্র ব্যবসায় বিনিয়োগ, উচ্চ শিক্ষা গ্রহণে বিনিয়োগ এবং জীবন ধারণের গুরুত্বপূর্ণ খাতে বিনিয়োগ। ফলে সঞ্চয়ের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত হয়, অর্থের নিরাপত্তা দান করা হয়, মুনাফা অর্জন এবং সদস্যদের জীবনযাত্রার মান উন্নত হয়। সুতরাং ক্রেডিট ইউনিয়ন বিভিন্ন প্রকার সঞ্চয় যেমন— দীর্ঘমেয়াদী শিক্ষা স্কীম, যুবস্কীম, হলিডে স্কীম, শিশু সঞ্চয়, অবসরকালীল সঞ্চয়, ইত্যাদি। সদস্যদের ভবিষ্যতের জীবনে যেমন সঞ্চয় অপরিহার্য তেমনী সদস্যদের ঋণ কার্যক্রম সচল রাখার জন্য সঞ্চয় গুরুত্বপূর্ণ। আবার ক্রেডিট ইউনিয়নের স্বনির্ভরতা অর্জনের জন্য সঞ্চয় একান্ত প্রয়োজন কারণ সঞ্চয়ের মাধ্যমে ক্রেডিট ইউনিয়নের মূলধন সৃষ্টি, ঋণ কার্যক্রম সচল, ঋণ খেলাপী রোধ, অনাদায়ী ঋণের ভবিষ্যৎ ব্যবস্থা সংরক্ষণ, মূলধন তহবিল দৃঢ়, তারল্য নিশ্চিত, আর্থিক কাঠামো সুদৃঢ় এবং আর্থিক ব্যবস্থাপনা গতিময় থাকে।

৪) বহুমূখী ঋণকার্যক্রমঃ 
ক্রেডিট ইউনিয়ন ঋণকার্যক্রমে রয়েছে ব্যাপক বৈচিত্র্য। যেহেতু সদস্যদের নানাবিধ আর্থিক চাহিদা পূরণার্থে ক্রেডিট ইউনিয়নের ঋণকার্যক্রম পরিচালিতা হয় তাই একক ঋণের ঝুঁকি মুক্ত থাকে। ক্রেডিট ইউনিয়ন ঋণকার্যক্রমের ক্ষেত্র হিসাবে গৃহণির্মান, বাড়িক্রয়, ক্ষুদ্র ব্যবসা, হস্তশিল্প, পরিবহন ব্যবসা, আত্ম—কর্মসংস্থান সৃষ্টি, ঋণফেরত, জরুরি নগদ অর্থের চাহিদা পূরণ, শিক্ষা, কৃষি, পশুপালন, খামার সৃষ্টি, হেচারী স্থাপন, ব্যক্তিগত ব্যয় নিবার্হ, এমননি বিভিন্ন বিল প্রদান, দেনা পরিশোধ, জীবনধারণের বিভিন্ন উপাদানও অন্তর্ভুক্ত থাকে। প্রকল্প ঋণের বিভিন্ন মেয়াদও বিবেচনায় থাকতে পারে যেমন— কৃষিঋণের ক্ষেত্রে ফসল ঘরে সংরক্ষণের পর থেকে নিয়মিত ঋণফেরত হতে পারে— এজন্য তিন চারে মাস সময় দেয়া যেতে পারে। আবার পশুপালন বা খামার স্থাপনের ক্ষেত্রে নগদ আয়ের অর্থ হস্তগত হওয়া পর্যন্ত ঋণফেরত অপেক্ষা করতে হতে পারে। তেমনিভাবে ক্ষুদ্র ব্যবসা বা আত্ম—কর্মসংস্থান ঋণ হতে পারে স্বল্প সময় যেমন ৩০ দিন, ৬০ দিন, ৯০ দিন মেয়াদ পর্যন্ত ফেরত কার্যক্রম অপেক্ষা করা যেতে পারে। মন্দা আক্রান্ত অথবা প্রাকিৃতিক দূর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় সুবিধামত ঋণফেরত প্রক্রিয়া প্রণয়ন করতে পারে যেন নিজের অবস্থার প্রেক্ষিতে আর্থিক সেবা গ্রহণ ও মূলধন সবল থাকে।

ঋণের ধরন বা মেয়াদ বা আকার বা আয়ের উৎস অনুযায়ী ঋণ লেনদেন নীতি, ব্যয় ও শর্তের ভিন্নতা থাকে পারে। এতে ঋণকার্যক্রমের ঝুঁকি হ্রাসসহ ঋণ কার্যক্রম চলমান থাকে। এতে স্বল্প আয়ের ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা সহজ ও নিরাপদ ঋণ গ্রহণের মাধ্যমে নিজের আর্থিক উন্নয়নের উৎসাহ পায়, সমাজে উদ্যোক্তা শ্রেনীর সংখ্যা বৃদ্ধির ফলে গোটা সমাজের আর্থিক অগ্রগতি তরান্বিত হয়। বলিভিয়া, ফিলিপাইন, আফ্রিকার বেশ কিছু স্থানে ক্রেডিট ইউনিয়ন স্বল্প আয়ের ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা দল গঠন করে ঋণ কার্যক্রমের মাধ্যমে সমাজে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা সৃষ্টিতে ভূমিকা পালন করে আসছে। দলের মাধ্যমে ঋণকার্যক্রমে যেমন অর্থের নিরাপত্তা নিশ্চত হওয়া যায় তেমনি সদস্যদের মাঝে ঋণ আদান—প্রদান অভ্যাস সৃষ্টি হয়। ফলে কোন এক সময় যোগ্য আত্ম—কর্মসংস্থান উদ্যোক্তা তৈরী হয় যারা প্রকল্প ঋণের মাধ্যমে সমাজে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে অর্থনৈতিক উন্নয়নে সক্রিয় ভূমিকা রাখতে পারে। ক্রেডিট ইউনিয়ন সর্বদা সদস্যদের উপযোগী করে নতুন নতুন সহজলভ্য ঋণ প্যাকেজ সৃষ্টি করে যেন সকল সদস্য চাহিদা মাফিক সবার্ধিক আর্থিক সেবা গ্রহণ করতে পারে।

ড. ফা.লিটন হিউবার্ট গমেজ, সিএসসি
ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগ (হিসাববিজ্ঞান)
নটর ডেম কলেজ, ঢাকা, বাংলাদেশ।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top